টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ‘বিস্ময়কর নেতা’ শেখ হাসিনা

টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ‘বিস্ময়কর নেতা’ শেখ হাসিনা

টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া ম্যাগাজিনটির প্রচ্ছদে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ছাপা হয়েছে। ‘শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ’ নামে বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

গত সেপ্টেম্বরে টাইম ম্যাগাজিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাৎকার নেয়। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন বিস্ময়কর রাজনৈতিক নেতা যিনি গত এক দশকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ব্যাপক উত্থান ঘটিয়েছেন।

টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার পর পুনরায় ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা বিশ্বের দীর্ঘতম নারী সরকার প্রধান শেখ হাসিনা এবং ইসলামপন্থী ও একসময় হস্তক্ষেপকারী সামরিক বাহিনী উভয়কেই দমন করার কৃতিত্ব পেয়েছেন। মার্গারেট থ্যাচার বা ইন্দিরা গান্ধীর চেয়েও বেশি নির্বাচনে জয়লাভের পর শেখ হাসিনা আগামী জানুয়ারিতে ব্যালট বাক্সে নির্বাচনের মাধ্যমে মেয়াদ বাড়াতে বদ্ধপরিকর। গত সেপ্টেম্বরে টাইম ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আমি আত্মবিশ্বাসী যে আমার জনগণ আমার সঙ্গে আছে এবং তারাই আমার মূল শক্তি'।

গত কয়েক বছর ধরে শেখ হাসিনা যে ১৯টি হত্যাচেষ্টার মুখোমুখি হয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে  প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সমর্থকরা নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। পুলিশের গাড়ি এবং বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো এবারও নির্বাচন বর্জনের অঙ্গীকার করেছে বিএনপি।

সমালোচকদের মতে; শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বাংলাদেশ কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে মোড় নিয়েছে। অন্যদিকে দেশটির দুইবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় কারাবন্দী। তিনি গুরুতর অসুস্থ। আর বিএনপি নেতাকর্মীরাও অনেক মামলার আসামি। এসব ঘটনাকে অনেকেই ‘হয়রানি’ হিসেবে অভিযোগ করেছেন। সমালোচকরা বলছেন, এ অবস্থায় আসন্ন জানুয়ারি মাসের নির্বাচন শেখ হাসিনার জয়কে ত্বরান্বিত করবে। সর্বশেষ গত দুটি নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে নিন্দা জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।

সম্প্রতি প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমর্থকরা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এতে গ্রেপ্তার হয়েছে দলটির শতাধিক নেতাকর্মী। পুলিশের যানবাহন ও পাবলিক বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়। বিএনপি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আসন্ন নির্বাচনও বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে। দলটির দাবি- নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তবে তাদের এ আহ্বানের নজির থাকলেও ক্ষমতাসীনদের বক্তব্য হলো- সংবিধান সংশোধনের পর এই সুযোগ নেই।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে যেখানে তিনি বলেছেন, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগসহ সব রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে শাসক দল। যখনই আমরা আওয়াজ তুলি তারা তখনই আমাদের নিপীড়ন করে।’

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সদস্যের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবদান সবচেয়ে বেশি। দেশটি নিয়মিতভাবে ইন্দো মার্কিন-প্যাসিফিক কমান্ডের সঙ্গে অনুশীলনে যোগ দিয়ে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় উৎস। এমনকি বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির শীর্ষ দেশও আমেরিকা।

ইউক্রেনে ভ্লাদিমির পুতিনের আগ্রাসনের নিন্দা জানানো উন্নয়নশীল বিশ্বের কয়েকজন নেতাদের একজন শেখ হাসিনা, যিনি নিজেকে পশ্চিমাদের জন্য দরকারি প্রমাণ করেছেন। প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয়ও দিয়েছেন তিনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘স্বৈরাচারের’দিকে বাংলাদেশের মোড নেওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন ওয়াশিংটন। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের আয়োজন গণতন্ত্র সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আর গত মে মাসে নির্বাচনকে দুর্বল করতে ভূমিকা রাখতে পারে এমন বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এর জবাবে শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে গণতন্ত্রকে বিদায় দেওয়ার চেষ্টা করছে।’ তার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জোর দিয়ে বলেছেন, ওয়াশিংটন বাংলাদেশে কোনো পক্ষকে সমর্থন করে না। এ ব্যাপারে তারা সতর্ক।

চীনের ক্রমবর্ধমান প্রতিটি প্রভাব মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র যখন মরিয়া ঠিক তখন বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট কঠোর নীতি অবলম্বন করছে। এ ব্যাপারে উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিদেশে তার গণতন্ত্র-প্রচার নীতির জন্য বাংলাদেশকে একটি পরীক্ষামূলক ক্ষেত্রে পরিণত করেছে বলে মনে হচ্ছে। এর বড় ঝুঁকি হলো- এ ধরনের সকল চাপের বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটবে। সরকারকে ক্ষমতায় থাকার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করতে প্ররোচিত করবে।’

শেখ হাসিনার টানা চতুর্থ মেয়াদ বাংলাদেশের জন্য কী অর্থ বহন করবে, তা একটি মেরুকরণমূলক প্রশ্ন। বেশিরভাগ আমেরিকান দেশটিকে কেবল তাদের তৈরি পোশাকে সেলাই করা লেবেল থেকে জানে । তবে এটি একটি বাস্তব যে মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনও দেশের চেয়ে বড় মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্যদের একটি উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু এখানে আছে। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও, ১৯৮৮ সালে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মে পরিণত করেছিলেন।

শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক সাফল্য প্রশংসনীয়। ২০০৬ সালে ৭১ বিলিয়ন ডলার জিডিপি থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে খাদ্য রফতানিকারক হয়ে উঠেছে। যা ভারতের পরে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। সামাজিক সূচকগুলো উন্নত হয়েছে। ৭১% মেয়েরা আজ প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। স্যামসাংয়ের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চীন থেকে সাপ্লাই চেইন সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে বাংলাদেশ হাই-টেক ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, ‘গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের উন্নতি করতে হবে। আমরা অনেক দূর এগিয়েও গেছি'।

বাংলাদেশও জলবায়ু সংকটের প্রথম সারিতে রয়েছে। পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত এই দেশটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু পানিই হাজার বছর ধরে এখানকার জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। অভ্যন্তরীণ থেকে হিমালয় পর্বতমালা থেকে প্রতি বছর ১৬৫ ট্রিলিয়ন গ্যালন বরফ বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। নিয়মিত সাইক্লোন-বন্যায় বছরে প্রায় ১৬৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। শেখ হাসিনা জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার জন্য ২০২৫ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, "আমরা শুধু প্রতিশ্রুতি পেতে চাই না, উন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।”

বাংলাদেশের রাজনীতির রক্তস্নাত ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রাষ্ট্রপতি, যিনি ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে পরিবারের ১৭ জন সাথে নিহত হন। অন্যদিকে রয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। যিনিও একটি সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন।

এই দুই রাজনৈতিক দল একে অপরকে তাদের ভূমিকা ছোট করে দেখে। বিএনপিকে 'সন্ত্রাসী দল' আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা বলেন, 'তারা কখনোই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। খালেদা জিয়া সামরিক স্বৈরশাসকের মতো শাসন করেছিলেন’। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি সমর্থকরা অগ্নিসন্ত্রাস করে যে সহিংসতা সৃষ্টি করেছিল, তাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। বিপরীতে, বিএনপি  সরকারের দমন-পীড়নের সমালোচনা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, "বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রায়শই রাস্তায় সহিংসতায় জড়ায়। এটা সব বড় রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই সত্য।”

শেখ হাসিনা স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স এবং আইডি কার্ড ও বায়োমেট্রিক তথ্যের সঙ্গে যুক্ত নিবন্ধন কাগজপত্র প্রবর্তনের কথা উল্লেখ করে অবাধ নির্বাচনের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তার রক্তে গণতন্ত্র আছে বলেও দাবি করেন তিনি। বাবার হত্যার পর শেখ হাসিনা ও তার বোন পশ্চিম জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়, তখন তাকে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ সমর্থক তাকে স্বাগত জানায়। পরবর্তী বছরগুলো নির্বাচন এবং সামরিক শাসনের অবসানের জন্য আন্দোলন করেন। তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের সংগ্রাম ছিল, ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার। এটাই ছিল আমাদের স্লোগান'।

কিন্তু চার দশকের মধ্যে অনেক কিছুই বদলে যেতে পারে এবং আজ বাংলাদেশের বিরোধীরা অভিযোগ করছে যে- তারা গ্রেপ্তার, আক্রমণ বা আইনি চ্যালেঞ্জের ভয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারে না। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, “অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শুধু নির্বাচনের দিনই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটি পুরো প্রক্রিয়া।”

১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে প্রতিটি নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্ষমতা রদবদল হয়েছে। ঢাকার এক রিকশাচালক টাইমের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘তার দৈনিক মজুরি ৪০০ টাকা (৩.৫০ ডলার) তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের রান্নার তেল ও মসুর ডালের খরচ বহন করতে পারছে না। শেখ হাসিনা একটি মহান পরিবার থেকে এসেছেন, কিন্তু তিনি আজ আমাদের সাহায্য করতে পারছেন না।’

শেখ হাসিনার জন্য বিপদজনক বিষয় হলো, যদি তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়, তাহলে তিনি সম্ভবত একই ধরনের দমনমূলক প্রতিশোধের মুখোমুখি হবেন। ঢাকার সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ থিংক ট্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও টকশোর উপস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেন, 'আওয়ামী লীগের সবাই খুব ভয় পাচ্ছে। তাদের নিরাপদ প্রস্থানের পথ নেই।’

বাংলাদেশের নিপীড়নমূলক দৃশ্যপট মূলত ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের ঘটনার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। রাত ৯টা ৪০ মিনিটে বোমা, পিস্তল, অ্যাসল্ট রাইফেল ও চাপাতি নিয়ে পাঁচজন ব্যক্তি ঢাকার গুলশান জেলার হলি বেকারিতে প্রবেশ করে। 'আল্লাহু আকবর' (আরবি ভাষায় 'আল্লাহ মহান') বলে চিৎকার করে তারা প্রধানত বিদেশি নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে এবং গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। আতঙ্কিত কর্মীরা ছাদ পেরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় অনেকে টেবিলের নিচে লুকিয়ে যান।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে,  এরপর তারা কোরআন তেলাওয়াত করতে না পারা যে কোনো জিম্মিকে নির্যাতন করে হত্যা করে। অবশেষে যখন পুলিশের অভিযানের মাধ্যমে জিম্মি সংকটের অবসান ঘয়, তখন মোট ২২ জন বেসামরিক নাগরিক - প্রধানত স্থানীয়, ইতালীয় এবং জাপানি - পাঁচজন সন্ত্রাসী এবং দুই জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছিল। আহত হন আরও ৫০ জন।

গত ১২ মাসে হিন্দু শিক্ষাবিদ এবং ধর্মনিরপেক্ষ লেখক ও ব্লগারদের লক্ষ্য করে ৩০টিরও বেশি সহিংস হামলা চালানো হয়েছে। ভয়ের পরিবেশ এতটাই বিস্তৃত হয়ে ওঠে যে, অনেক রেস্তোঁরায় বিদেশিদের নিষিদ্ধ করে। যাতে তারা আরেকটি টার্গেটে পরিণত না হয়। আজ, যে রাস্তায় এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল সেখানে কেবল বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ এবং একটি মেডিকেল ক্লিনিক রয়েছে। তবুও সহিংসতার সেই স্মৃতি আজও মনে করিয়ে দেয়।

১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইসলামীকরণ শুরু করে। তার বিএনপি আজ আরও রক্ষণশীল গোষ্ঠীর সাথে জোটবদ্ধ রয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে আসছে। উইলসন সেন্টারের কুগেলম্যান বলেন, ‘ঢাকা বিরোধী দলের ইসলামপন্থী উপাদানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অজুহাত হিসেবে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী প্রয়োজনীতাকে ব্যবহার করেছে। সন্ত্রাসবাদ আজ কারণ হিসেবে বিবেচিত। বিএনপির সাম্প্রতিক সমাবেশে পুলিশের কর্মকাণ্ডকে 'উস্কানিমূলক' আখ্যায়িত করেছেন সৌরভ গাঙ্গুলি। যা প্রতিশোধের দিকে পরিচালিত করেছে।"

কিন্তু রাস্তায় শুধু পাথর আর লাঠিই নয়; বাংলাদেশের বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শেখ হাসিনার কথিত শত্রুদের টার্গেট করেছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা অনুসন্ধানকারী দুই বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মীকে নেতিবাচক অভিযোগে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

গত আগস্টে বারাক ওবামাসহ বিশ্বের ১৭০ জনেরও বেশি নেতা ও নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশের ২০০৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের 'ক্রমাগত বিচারিক হয়রানি' বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘন, দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংসহ ১৭৪টি অভিযোগ এনেছে আওয়ামী লীগ সরকার।

রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়ে গেছে। কক্সবাজারের সমুদ্রতীরবর্তী থেকে এক ঘণ্টা দক্ষিণে চলুন দেখবেন- প্লাস্টিকের চাদরে আচ্ছাদিত বাঁশের কুঁড়েঘর। কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের অভ্যন্তরে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী পশ্চিম মিয়ানমারে সরকারি গণহত্যা থেকে পালিয়ে এসেছে। সেখানে আনুমানিক ২৪,০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

গাঙ্গুলি বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়ার অর্থ -আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অন্যান্য মানবাধিকার উদ্বেগ উত্থাপন করতে অনিচ্ছা রয়েছে। কিন্তু আজ, নির্বাচনের ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে পশ্চিমা চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৫৪ বছর বয়সী শরণার্থী শরিফ হুসেইন বলেন, 'এখন আমাদের জনগণের ওপর ফিরে আসার জন্য আরও বেশি চাপ রয়েছে।’ তিনি বলেন, 'আমরা মরব বা যাই হোক না কেন, বাংলাদেশ তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা শুধু আমাদের জনগণকে তাদের ভূমি থেকে সরিয়ে দিতে চায়।’

রোহিঙ্গাদের বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দেন, 'ছয় বছর ধরে আমি ও আমার বোন শরণার্থী হিসেবে দেশের বাইরে ছিলাম, তাই আমরা তাদের দুঃখ ও বেদনা বুঝতে পারি। ‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বোঝা’ বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সংস্থা যারা এখানে (রোহিঙ্গাদের) সমর্থন করছে তারাও মিয়ানমারের অভ্যন্তরে একই কাজ করতে পারে।

আয়তন ও ভৌগোলিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ ভারত, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখেছে। বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি রয়েছে। যেখানে রুশ প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও সুশীল সমাজকে আশ্রয় দিচ্ছে। ঝুঁকি হচ্ছে, অত্যধিক চাপ ঢাকাকে ওয়াশিংটন থেকে দূরে এবং মস্কো ও বেইজিংয়ের কাছাকাছি ঠেলে দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা ইউক্রেন থেকে রাশিয়াকে প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। তিনি পরিষ্কার জানান, ‘কিছু ইস্যুতে আমরা রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দেইনি। এরপর আরও কিছু ইস্যুতে আমরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেই।  তিনি বলেন, "আমাদের অবস্থান খুবই পরিষ্কার।”

এটি এমন একটি পদ্ধতি যা ঢাকাকে খোলাখুলিভাবে উভয় পক্ষের বিরোধী না দেখানোর সিদ্ধান্ত। গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ রাশিয়ার প্রথম শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকা সফর করেন এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রোসাটম ঢাকার ৯০ মাইল পশ্চিমে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। গত ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ এই প্ল্যান্টের জন্য রাশিয়ান ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান পেয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, 'তাদের সবাইকে থামতে হবে। পুতিনকে থামাতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের উচিত যুদ্ধে উস্কানি না দেওয়া এবং অর্থ সরবরাহ বন্ধ করা। তাদের উচিত সেই টাকা শিশুদের দেওয়া।"

বাংলাদেশের নতুন সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে শেখ হাসিনা আবারও আত্মরক্ষামূলক মনোভাব পোষণ করে বলেন, 'আপনি যা কিছু করেন, কিছু মানুষ সবসময় এর বিরোধিতা করে। শেখ হাসিনা বলেন, 'আমি এখানে এসেছি শুধু আমার বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য।” তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে আমাকে উৎখাত করা এত সহজ নয়। আমি আমার জনগণের জন্য মরতে প্রস্তুত।’